দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিজস্ব জনবলের জন্য পরিচালক পদটি যেন সোনার হরিণ! যার নাগাল পাওয়াই দুষ্কর। তাই পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্য হয়েও বঞ্চিত হচ্ছে দুদকের নিজস্ব জনবল। চাকরিবিধিতে পদোন্নতি দিয়ে পরিচালক পদে পদায়নকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর পদোন্নতিযোগ্য জনবল না থাকলে প্রেষণের মাধ্যমে পদায়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, দুদক প্রেষণকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। তার ওপর পদোন্নতিতে পিক অ্যান্ড চুজ কৌশলের কারণে কর্মকর্তাদের মাঝে বিরাজ করছে অস্বস্তি। অতীতে পিক অ্যান্ড চুজের ঘটনা ঘটেছে বলে পদোন্নতিবঞ্চিতদের দাবি।
সূত্র জানিয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-১ অধিশাখার ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বরের এক প্রজ্ঞাপনে দুদকে প্রেষণে কর্মরত দুই উপপরিচালককে পরিচালক পদে পদায়ন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ন্যস্ত করা হয়। তারা হলেন কাজী মো. সায়েমুজ্জামান (১৬৩৮২) ও শেখ মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর (১৬৪১৬)। আর গত ২৩ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে মো. শাহীনুজ্জামান (১৬৫১৯) ও তৌহিদুজ্জামান পাভেলকে (১৬৪৭৫) পরিচালক পদে দুদকে বদলি করা হয়। এই দুটি পদায়ন আদেশ কমিশনে কর্মরত সর্বস্তরের কর্মচারীর মাঝে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তারা চারজনই ২৮তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের চারজনেরই চাকরিকাল প্রায় ১১ বছর। অথচ দুদকে ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে ৩৪ জন কর্মকর্তা কাজ করে যাচ্ছেন, যারা প্রায় ১২ বছর ধরে উপপরিচালক পদেই কর্মরত। নিজস্ব যোগ্য কর্মকর্তা থাকাবস্থায় এ ধরনের পদায়ন সবাইকে হতাশ করেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, পর্যবেক্ষণ ও বিশারদ এবং গোয়েন্দা ইউনিট, দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল এবং প্রশিক্ষণ, মানিল্ডারিং এবং বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সিস্টেম উন্নয়ন ও সমন্বয় এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা শাখাগুলোয় দুজন করে পরিচালকের স্থলে একজন দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া বিশেষ তদন্ত-২, প্রতিরোধ-২ এবং অনুসন্ধান ও তদন্ত-৬ শাখা তিনটির পরিচালক পদও খালি রয়েছে। এদিকে অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ এবং বিশেষ তদন্ত-১ শাখার দুই পরিচালকের (প্রেষণে আসা) বদলি আদেশ হলেও তারা এখনও যাননি। তারা চলে গেলে এই দুটি পদও খালি হওয়ার কথা।
পরিচালকের মোট ৩৭টি পদের মধ্যে প্রধান কার্যালয়ে ২৯ ও বিভাগীয় কার্যালয়ে রয়েছে ৮টি। তার মধ্যে প্রধান কার্যালয়ে ৭টি পদ শূন্য রয়েছে।
জানা গেছে, পদোন্নতির জন্য বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভায় পরপর তিনবার বিবেচিত না হলে পরে আর পদোন্নতির জন্য বিবেচিত না হওয়ার একটা প্রচলন রয়েছে। সেই হিসেবে ১৯৯৫ সালের ব্যাচের কর্মকর্তারা বর্তমানে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় বিবেচিত হবেন না বলে জানা গেছে। এতে এই উপপরিচালকদের মাঝেও চরম হতাশা বিরাজ করছে। কিন্তু, তারা জানেন না তাদের কী দোষ? ২০১৮ সালে পদোন্নতির জন্য বিবেচনার সময় তাদের বিষয়ে একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য ছিল! কিন্তু, কী মন্তব্য ছিল, তা তারা জানেন না। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তাদের পরের ক্রমিকে থাকা উপপরিচালকদের গত বছর পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়। কয়েকজনকে পদোন্নতিও দেয়া হয়। তখনও তাদের বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, আগের কমিশন তাদের পদোন্নতি দেয়নি, তাই বর্তমান কমিশনও দেবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদমর্যাদায় তারা ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্টি করাপশন অফিসার (ডিএসিও) হিসেবে তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরোয় ১৯৯৫ সালে যোগ দেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে তাদের নিয়োগ হয়। অথচ ওই সময়ে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) পদে যোগদানকারী কর্মকর্তারা পরিচালক পদে পদোন্নতি পেলেও তারা পাননি!
এদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় ১৯৯৪ সালের মে মাসে পরিদর্শক পদে তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে ২৮ জন কর্মচারী যোগদান করেন। তারাও পিএসসির লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পান। ২০০৮ সালে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদায় সহকারী পরিচালক (এডি) পদে তারা পদোন্নতি পান। ২০১২ সালে উপপরিচালক (ডিডি) পদে পদোন্নতি পান। তারপরই তাদের মধ্যে ২০ জনের ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় কালোমেঘ! তাদেরও আর পদোন্নতি হয়নি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে এক দশক।
দুদক চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী উপপরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতি পেতে হলে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে ১২ বছর চাকরির মেয়াদ পার হতে হয়। আর উপপরিচালক পদে কমপক্ষে ৩ বছর পার করতে হয়। পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে পদোন্নতিই প্রথম ধাপ হিসেবে রাখা হয়েছে। আর পদোন্নতিযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার সামরিক বা বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রেষণে বদলির মাধ্যমে এবং প্রেষণে যোগ্য কর্মকর্তা পাওয়া না গেলে চুক্তিভিক্তিক নিয়োগের মাধ্যমে পরিচালক পদে পদায়ন করা হয়।
চাকরি বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩ নম্বর বিধিতে নিয়োগ পদ্ধতিতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ১৬ (৪) ধারামতে এবং তফসিলে বর্ণিত বিধান প্রতিপালন সাপেক্ষে স্থায়ীভাবে শূন্য হইয়াছে এইরূপ কোনো পদে নি¤œবর্ণিত পদ্ধতিতে নিয়োগদান করা যাইবে : (ক) সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে; (খ) পদোন্নতির মাধ্যমে; (গ) প্রেষণে বদলির মাধ্যমে; এবং (ঘ) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে। একই অধ্যায়ের ৮ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, (ক) প্রেষণের সময়কাল, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া, তিন বৎসরের অধিক হইবে না; (খ) মাতৃসংস্থার চাকুরীতে কর্মকর্তার পূর্বস্বত্ব থাকিবে এবং প্রেষণের সময়কাল শেষ হইবার পর অথবা তৎপূর্বেই ইহার অবসান ঘটিলে তিনি মাতৃসংস্থার চাকুরীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন। কিন্তু, সেটাও হচ্ছে না। অনেকেই বদলি আদেশের পরও ইচ্ছেমতো থেকে যাচ্ছেন দুদকে।
সূত্র বলছে, দুদক একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা করে থাকে। পরিচালক পদটি মূলত তদারককারী কর্মকর্তার পদ। প্রেষণে পদায়ন করা কর্মকর্তাদের অনুসন্ধান ও তদন্তের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অথচ নিজস্ব কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা ৩০ বছরের অধিক। দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সময় অনুসন্ধান ও তদন্তের সংখ্যা বিবেচনায় নেয়া হয় এবং যেসব আইন ও বিধি নিয়ে কমিশন কাজ করে সেসব বিষয়ের দক্ষতার বিষয়টি নিজস্ব কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হলেও প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ নেই। তদারকির দায়িত্ব পালন করতে হলে সরাসরি অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে অভিজ্ঞতা থাকা একান্ত আবশ্যক। কিন্তু যাদের পদায়ন করা হয়েছে, তাদের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ইতঃপূর্বে যারা দুদকে প্রেষণে কাজ করেছে তাদের অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের ও তদন্ত শেষে বিজ্ঞ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরিসংখ্যান নিলে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া যাবে।
নিজস্ব জনবলকে বাদ দিয়ে পরিচালক পদে প্রেষণে কেন জনবল নিয়ে আসা হয়, জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এটা তো নতুন কিছু না, সবসময় আসে। প্রেষণ থেকেও আসে। এখান (দুদক) থেকেও পদোন্নতি দেয়া হয়। দুটাই ব্যবস্থা আছে।’
প্রেষণকে কেন প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা হয়ে আসতেছে। আমাদের প্রশাসনিক স্বার্থে এটা প্রয়োজন আছে, এজন্য করা হচ্ছে।’
এখন শূন্য পদ পূরণে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। আবারও দেয়া হবে। এটা চলমান প্রক্রিয়া।’
পদোন্নতির ক্ষেত্রে পিক অ্যান্ড চুজ প্রয়োগ হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা যোগ্য তারা কেউ বাদ পড়বেন না। যোগ্যরা সবাই পদোন্নতি পাবেন।’