বাগেরহাটের চিংড়ি-চিংড়ির দাম ও রপ্তানি দুটিই কমেছে

বাগেরহাটের চিংড়ি-চিংড়ির দাম ও রপ্তানি দুটিই কমেছে

দেশের বাজারে গত কয়েক মাসে চিংড়ি খাদ্যের দাম বেড়ে দুই থেকে তিন গুণ হয়েছে। এতে পণ্যটির উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। অন্যদিকে মানভেদে প্রতি কেজি চিংড়ির দাম ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। সেই সঙ্গে রপ্তানিও কমেছে ৩১ শতাংশ। এতে বেশ বিপাকে পড়েছেন চিংড়িঘেরের মালিক ও চাষিরা। 

চিংড়িঘেরের মালিক ও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেট করে চিংড়ি খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে। আবার রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশি চিংড়ির দুই বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রে চিংড়ির চাহিদা কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থায় করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা চিংড়িচাষি ও রপ্তানিকারকেরা চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

এভাবে চলতে থাকলে অনেকেই চিংড়ি চাষ থেকে সরে আসতে বাধ্য হবেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনা প্রয়োজন।

ফকির মহিতুল ইসলাম, সভাপতি, বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতি 

একসময় দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য ছিল চিংড়ি। কিন্তু গত কয়েক বছরে এটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এখন চিংড়ি দেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে।

বাগেরহাটের স্থানীয় চাষি ও মৎস্য আড়তমালিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চিংড়ির আকার ৪–৮ সেন্টিমিটার হলে সেগুলোকে বিক্রির উপযোগী বলে ধরা হয়। আর দাম নির্ভর করে গ্রেডের (আকার) ওপর। ২৫-৩০টিতে কেজি হয় এমন গ্রেডের প্রতি কেজি বাগদা চিংড়ির পাইকারি দাম ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ৯০০ টাকা। বর্তমানে তা ৫২০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ৪০টির বেশি হওয়া প্রতি কেজি বাগদার দাম আগে ছিল ৫০০ টাকা, তা এখন ৩০০ টাকার নিচে। অন্যদিকে ১০-১২ গ্রেডের প্রতি কেজি গলদার পাইকারি দাম ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে কমে ১ হাজার ১০০ টাকায় নেমে গেছে। এর চেয়ে ছোট আকৃতির গলদা আগে যেটা বিক্রি হতো ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় সেটি বর্তমানে ৬০০-৭০০ টাকা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানি ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেবার চিংড়ি রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪০ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের ৪ হাজার ১৫৪ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০২ টাকা ধরে। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫০ কোটি ডলার। তবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে চিংড়ি রপ্তানি খাতে আয় ৩১.৪৭ শতাংশ কমেছে।

বাগেরহাট সদর উপজেলার কাশেপুর গ্রামের চিংড়িচাষি মো. কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিংড়ি চাষ করা এখন আমাদের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ, চিংড়ি খাদ্যের দাম যে হারে বেড়েছে আর চিংড়ির দাম যেভাবে পড়েছে, তাতে আমাদের টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, গত ছয় মাসে প্রতি কেজি চিংড়ির দাম ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। অন্যদিকে  খাদ্যের দামসহ অন্যান্য খরচ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।  

জেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন চিংড়িচাষি জানান, এক বছর আগেও প্রতি বস্তা (৩৪ কেজি) গমের ভুসি বিক্রি হতো ৮০০ টাকায়, যা বর্তমানে ১ হাজার ৯০০ টাকা। একই সময়ে ৫০ কেজির এক বস্তা পালিশ কুঁড়ার দাম ৬০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৭০০ টাকায় উঠেছে। প্রতি বস্তা (২৫ কেজি) ফিশ ফিড ৮০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং এক বস্তা (৫০ কেজি) সয়াবিন খইল ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৭১০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

ঘেরমালিকা ও চাষিদের দাবি, এক দিকে তাঁদের বেশি দামে চিংড়ি খাদ্য কিনতে হয়, অন্য দিকে চিংড়ি বিক্রির সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ওপর বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভাইরাসসহ রোগব্যাধি ও খাদ্যে ভেজালের কারণে তাঁদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

জেলার মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, বাগেরহাটে ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি চিংড়িঘের রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫২ হাজার ঘেরে বাগদা এবং ২৬ হাজার ঘেরে গলদা চিংড়ি চাষ হয়।

বাগেরহাট জেলা চিংড়িচাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম বলেন, চিংড়ি খাদ্যের দামসহ শ্রমিকের মজুরি, পোনার দাম ও পরিবহনসহ সব খরচ বাড়লেও উৎপাদিত চিংড়ির দাম বাড়েনি। এভাবে চলতে থাকলে অনেকেই চিংড়ি চাষ থেকে সরে আসতে বাধ্য হবেন।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাগেরহাট জেলায় প্রায় ৪০ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছিল, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। একই সময়ে এই জেলা থেকে চিংড়ি রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।

এদিকে বাগেরহাটের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল জানান, চাষিরা যাতে সরাসরি কোম্পানির কাছে চিংড়ি বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পান, সে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply