ব্যাংকের আমানত বাড়লেও কমেছে প্রবৃদ্ধি

ব্যাংকের আমানত বাড়লেও কমেছে প্রবৃদ্ধি

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংকগুলোয় আমানত বাড়লেও প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। ২০২২ সাল শেষে আমানত বেড়েছে ৮৬ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। ফলে বছর শেষে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ২০২১ সালে ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২১ সালে আমানত যেভাবে বেড়েছে, গত বছর সেভাবে বাড়েনি। তাই প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় কমেছে। প্রবৃদ্ধি ভালো না হওয়ায় ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট বেড়েছে।

ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার জন্য ডলার সংকট একটি কারণ। ডলার সংকটের কারণ আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এ সময় ভোক্তার আয় সে অর্থে বাড়েনি। বাড়তি দামে পণ্য কেনার কারণে ভোক্তারা আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকে নতুন সঞ্চয় কমে গেছে। একই সঙ্গে ভোক্তাদের সংসারের বাড়তি ব্যয় মেটাতে ব্যাংক থেকে আগের সঞ্চয় ভেঙে খরচ করতে হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক আমানত প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানত ছিল ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ৩১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৪ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে ৮৬ হাজার ৯৩২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০২২ সালে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা ২০২১ সালের চেয়ে কম। ২০২১ সালে সামগ্রিকভাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

২০১৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশশিক ৬৭ শতাংশ। ২০২১ তুলনায়  ২০২২ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমরানুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ ডলার সংকট। এ কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমদানি বিল নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে প্রচুর ডলার নিয়েছে। ফলে বাজার থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। তাই তারল্যের ওপর চাপ পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্য ও স্থায়ী আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। ছোট আমানতকারীরা তাদের সঞ্চয় ভেঙে চাহিদা মেটাচ্ছেন। জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে অনেক পরিবার সঞ্চয় বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ব্যাংকগুলো যেসব অর্থায়ন দেশে আনত, তা অনেক কমে গেছে। এখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চিন্তা করে তারা ঋণ কম দিচ্ছে। সব মিলিয়ে আমানতের ওপর প্রভাব পড়েছে। তাই প্রবৃদ্ধি কমেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ থাকলেও গত ৩ মাসে তা কিছুটা কমেছে। নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এর আগের মাস অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। সে হিসাবে এ হার সামান্য কমেছেÑশূন্য দশমিক ৬ শতাংশ।

ডলারের অতিরিক্ত ব্যয় ও আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংক খাতের উদ্ধৃত তারল্য কমেছে। গত এক বছরে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৬৫ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে তারল্য কমে এক লাখ ৪৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ‘ব্যাংক খাতে টাকা নেই’। এর প্রভাব পড়ে পুরো ব্যাংকিং খাতে। এ সময় মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেদের কাছে রাখে। ফলে দেখা যায় গত নভেম্বরে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানত কমেছে। তবে ডিসেম্বরে আবার টাকা ব্যাংকে ফেরে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত নভেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৬২৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, যা ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৯৬৪ কোটি ৪ লাখ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে ১২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

অন্যদিকে গুজবে ?ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজের কাছে রাখার প্রবণতা হঠাৎ বেড়েছিল। এ প্রবণতা ব্যাংকগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। ঘরে রাখা টাকা আবার ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর শেষে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। ১৭ নভেম্বর তা বেড়ে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা হয়। গত ১ ডিসেম্বর গিয়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৮ ডিসেম্বর আরও বেড়ে প্রচলনে যায় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। ১৫ ডিসেম্বর শেষে তা ২ লাখ ৯৪ হাজার ৭৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এরপর গতি কিছুটা কমে ২২ ডিসেম্বর ২ লাখ ৯৪ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা হয়। এরপর থেকে আবার কমতে শুরু করেছে। ২৯ ডিসেম্বর প্রচলনে থাকা নোটের পরিমাণ নেমেছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকায়। এর পরের হিসাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এরই মধ্যে তা ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমেছে বলে জানা গেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, দেশে অধিক মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঞ্চয় করার সক্ষমতা নেই। ব্যয় যতটা বেড়েছে, আয় ততটা বাড়েনি। তাই মানুষ সঞ্চয় থেকেও ভেঙে খাচ্ছেন। নতুন করে সঞ্চয় হচ্ছে না। তাই আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় কমেছে।

Leave a Reply