ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেয়া, গ্যাস ও বিদ্যুতের ভর্তুকি কমিয়ে আনা, আয়কর আইন সংশোধন, জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা, বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে এভাবেই সংস্থাটির দেয়া শর্ত একের পর এক বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। মানা হয়েছে সংস্থাটির ৩০ শর্ত, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় গত বছর আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার ঋণ চায় বাংলাদেশ। গত নভেম্বর সংস্থাটির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর চলতি মাসের মাঝামাঝি আইএমএফের ডিএমডির সঙ্গে এ বিষয়ে চূড়ান্ত বৈঠক হয়। আর চূড়ান্ত ঋণ প্রস্তাব আইএমএফের বোর্ডসভায় উঠছে আগামীকাল।
আইএমএফ বোর্ডসভায় বাংলাদেশের আবেদন আগামীকাল মঞ্জুর হলে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তি আসবে। এরপর ঋণ প্রস্তাবে উল্লিখিত সংস্কারমূলক কাজ পূরণসাপেক্ষে ৬টি সমান কিস্তিতে বাকি অর্থ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের সর্বশেষ কিস্তি পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর। আইএমএফের ঋণের সুদহার হবে বাজারদর অনুযায়ী, তাতে গড় সুদহার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের বর্ধিত ঋণ সুবিধা এবং বর্ধিত তহবিল সুবিধা (ইসিএফ/ইইএফ) থেকে ৩২০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাবে বাকি ১৩০ কোটি ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৪২ মাসের এই ঋণ কর্মসূচিতে ৩০টি শর্ত রয়েছে, যা ৩টি বিভাগের অধীনে পড়ে। এগুলো হলোÑগুণগত মান উন্নয়ন-সংক্রান্ত শর্ত (কিউপিসি), অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন-সংক্রান্ত শর্ত (এসপিসি) ও সাধারণ প্রতিশ্রুতি। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগী এ সংস্থাটি ৩টি বাধ্যতামূলক শর্ত দিয়েছে। এ শর্তগুলো কিউপিসির অধীনে পড়ে। সেই শর্তগুলো হলোÑনেট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের একটি ন্যূনতম স্তর নির্ধারণ এবং সরকারের বাজেট ঘাটতির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ।
আইএমএফ বিভিন্ন কিস্তিতে অর্থ দেয়ার আগে সরকারকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কিউপিসির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। কিউপিসির ৩টি লক্ষ্যমাত্রা প্রতিটি কিস্তির সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। এসপিসির শর্তগুলোও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে সাধারণ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কিছুটা ছাড় পাবে বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রমতে, আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে এরই মধ্যে তুলে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঋণের ৯ শতাংশ সুদের হারের সীমা, রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণও এরই মধ্যে উল্লেখ করেছেন গভর্নর, ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর কাজ চলছে, চলতি অর্থবছরেই দ্বিতীয়বারের মতো মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। আয়কর আইনও এরই মধ্যে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শিগগিরই তা যাবে বিল আকারে সংসদে।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এটি চূড়ান্ত হলে প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করা হবে। আইএমএফের দেয়া শর্তগুলোর মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, আদায়ের অযোগ্য ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন, করছাড়ের ওপর বিস্তারিত নিরীক্ষা করা, বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক ব্যয়ের (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা কমূর্সচি) জন্য রাখা এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়ানোÑএ শর্তগুলোও মেনে নিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।
ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হিসাবেও ত্রুটি সংশোধনে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে পণ্য আমদানি মূল্যের সঙ্গে ফ্রেড ফরোয়ার্ড চার্জ, বিমা চার্জ, জাহাজ ভাড়া ইত্যাদি যোগ করা হবে। ব্যাংক খাতের আরও কিছু শর্ত মানা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑঅভিন্ন এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ, খেলাপি ঋণ কমানো, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি কমিয়ে আনা, ব্যাংক পর্ষদ গঠনের আইনের সংস্কার, ব্যাংকের আইটি খাতের সংস্কার, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা, খাতভিত্তিক আর্থিক ইন্ডিকেটরস প্রকাশ, বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ১০টি দুর্বল ব্যাংকের জন্য নেয়া উদ্যোগ আইএমএফকে জানানো, ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্ট (এফএসএসপি) বাস্তবায়ন, ব্যাংক সুপারভিশন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন (সংশোধন) আইনসহ ৫টি অন্যতম আইনের সংস্কার। এগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।